Wednesday, 27 October 2010

 মূল্যসূচক নিয়ে লুকোচুরি

শেয়ারের মূল্যসূচক সংশোধন করতে গিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অনুমোদন ছাড়াই এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সংস্থাটি। এমনকি বিষয়টি সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ বাজারসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষকেই অবহিত করা হয়নি।
গত ১ জুলাই থেকে ডিএসইতে নতুন তালিকাভুক্তসহ মোট ২৪টি কোম্পানির কেবল লেনদেনযোগ্য (ফ্রি ফ্লোট) শেয়ার নিয়ে সূচক গণনা করা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের বা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া যেসব শেয়ার সাময়িকভাবে বিক্রি নিষিদ্ধ (লক-ইন) রয়েছে, তা সূচক গণনায় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।
পুঁজিবাজারের নিয়মানুযায়ী, তালিকাভুক্তির অনুমোদন পাওয়ার তিন বছর পর্যন্ত উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে। আর প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ পাওয়া শেয়ার বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে এক বছর পর্যন্ত।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে গোপনে সূচক সংশোধন করা নৈতিকতাবিরোধী এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা। কারণ শেয়ারবাজারের জন্য সূচক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমেই বাজারের গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সূচকের প্রভাব অনেকখানি। তাই এর কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অবশ্যই অবহিত করতে হবে।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না এ রকম কোনো ঘটনা ঘটানো সম্ভব।’
যোগাযোগ করা হলে এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার বলেন, ডিএসই কোনোভাবেই এটি করতে পারে না। কীভাবে এই ঘটনা ঘটল, তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে তালিকাভুক্তির প্রথম দিন থেকেই এসব শেয়ার সূচক গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হতো। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্রামীণফোনের সূচক গণনার সময়ও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এ কোম্পানিটির উদ্যোক্তাদের অংশসহ মোট শেয়ারের পরিমাণ ১৩৫ কোটি দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৭টি। আগের পদ্ধতিতে সূচক গণনার সময় এর পুরোটাই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ হিসেবে শেয়ারটির দাম এক টাকা বাড়লে ডিএসইর সূচক বাড়ত প্রায় চার পয়েন্টের মতো। কিন্তু এখন সূচক গণনার সময় কোম্পানিটির বর্তমানে লেনদেনযোগ্য মাত্র ছয় কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার শেয়ার হিসেবে নেওয়া হচ্ছে, যা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র পাঁচ শতাংশ। ফলে এখন গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম এক টাকা বাড়লে সূচক বাড়ে মাত্র দশমিক ২৪ পয়েন্ট। এর মানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়লে বা কমলে সূচকে আগের মতো প্রভাব পড়ে না।
একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে অন্য ২৩টি কোম্পানির ক্ষেত্রেও। এসব কোম্পানির সূচক গণনায় কেবল লেনদেনযোগ্য শেয়ার হিসাবভুক্ত করা হলেও, বাজার মূলধন হিসাবের সময় আবার সব শেয়ারকেই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সূচককে কম দেখানোর কৌশল হিসেবেই অত্যন্ত গোপনে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক বিনিয়োগকারী সূচক দেখে বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এভাবে কৌশলে সূচক কমানোর চেষ্টা না করা হলে তাঁদের অনেকে হয়তো বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতেন না।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সূচকে কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটা করতে হলে আগে থেকে বাজারকে অবহিত করতে হবে। কী পদ্ধতিতে করা হবে, সেটাও জানাতে হবে। এসইসির অনুমোদনও লাগবে। এগুলো ছাড়া কীভাবে সূচক পরিবর্তন করা যায়, সেটাই তো বড় প্রশ্ন।
এ ব্যাপারে ডিএসইর অবস্থান সম্পর্কে জানতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতীপতী মৈত্রর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, এসইসির একজন সদস্যের মৌখিক নির্দেশে এসব করা হয়েছে।
জানা যায়, গত ২ জুন ওই সদস্যের সভাপতিত্বে স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক সমন্বয়ের নির্দেশনা পর্যালোচনার জন্য একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বৈঠকে পাঁচজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অভিন্ন মূল্যসূচক সমন্বয়পদ্ধতির নির্দেশনায় বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অফ সিকিউরিটিজ কমিশনস বা আইএসকোর কারিগরি কমিটির সুপারিশ নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনের ব্যাপারে সবাই একমত হন। বৈঠকে এসব ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সহায়তা নিয়ে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন সূচক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও নতুন সূচক বাস্তবায়নের ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ এসইসির চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছাড়াই সূচক সংশোধন করে বসেছে ডিএসই।
এদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক গণনায় অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিল না। গ্রামীণফোনের লেনদেন শুরুর দিন ডিএসইর সাধারণ সূচক অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে। গত জানুয়ারি মাসে প্রথম আলো ডিএসইর সূচকের ভুল গণনা নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। সূচক নিয়ে ওই সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।
ডিএসই ১৯৯৮ সালে সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএসকোর নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণের ঘোষণা দেয়। কিন্তু শুরু থেকেই বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়নি সংস্থাটি; বরং লুকোচুরি করছে।

Blog Archive